ধারাবাহিক উপন্যাসঃ নাইয়র (পর্ব-এগার)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৫:০১:১৮ বিকাল
শিকদার বাড়ির কাছারি ঘরে সবাই চুপ হয়ে আছে। একটু আগে মুজিবর বেশ সময় নিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে এক আবেগঘন বক্তব্য দিয়েছে। সবাই সেই কথার রেশ সামলানোর জন্য নিজেদের অজান্তেই এই মৌনতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কথা হচ্ছিল আছিয়া বেগমের ভিক্ষা করা নিয়ে। একজন মা আমাদের জন্য কি করেন, কতটা ত্যাগ স্বীকার করেন, কতটা কষ্ট সহ্য করেন এসবই আছিয়া বেগমের ছেলে চান মিয়াকে লক্ষ্য করে মুজিবর বলছিল। এক পর্যায়ে সে জিজ্ঞেস করে, ‘ তুমি এরকম জোয়ান ছেলে থাকতে তোমার মাকে কেন ভিক্ষা করতে বের হতে হল?’ চান মিয়া চুপ থাকে। মুজিবর আবারও একই প্রশ্ন করাতে সে বলে, ‘ ঘরে খাওনের খুব অসুবিধা। আমি চাষাবাদ কইরা যা আয় করি, তাতে আমাগো তিনজনের ভালোভাবে চলে না। তাই...’। হাবিব মুন্সী চান মিয়ার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠলেন, ‘ তাই নিজের মায়রে ভিক্ষা করতে পাঠাবি? তোর বউরে পাঠাইতি?’ মাথা নীচু করে চান মিয়া মিনমিন করে বলে, ‘এইডা কি কইলেন চাচা? বউ ঘরের বাইর হইলে মান-সম্মান থাকবে?’
উপস্থিত সবাই ওর এই কথায় বিস্ময় প্রকাশ করে। গুঞ্জন শোনা যায়। হাবিব মুন্সী রাগত স্বরে বলে, ‘ ওরে আহাম্মক! বউ ঘরের বাইর হইলে মান-সম্মান যায়, আর তোরে জন্ম দিছে যে মা, সে ভিক্ষা করলে জাত যাবে না!’ এ কথা বলে হাবিব মুন্সী উপস্থিত সকলের দিকে তাকায়। পারুলের বাবা চান মিয়াকে বুঝায়, ‘ দেখ বাবা, মা হইলো পোলাপানের জন্য বেহেশতো খানা। সেই মায়রে এই অপমান আর করিস না বাজান। দরকার হইলে নিজেরা একটু কম খাবি... কিন্তু তোর মারে আর ভিক্ষা করতে পাঠাইস না।‘
চান মিয়া এবারে মাথা তোলে। সকলের দিকে তাকায়। কিন্তু কথা বলে মুজিবরের দিকে তাকিয়ে, ‘ আমি আমার মায়রে আমার সাথে রাখতে পারমু না।‘ ওর এই কথা শুনে গ্রামবাসীদের ভিতর যারা এখানে রয়েছে সবাই ছি ছি করে উঠলো। এই সকল বয়স্ক মানুষেরা তাঁদের যার যার মাকে হারিয়েছে অনেক আগেই। তাঁদের সকলের স্মৃতির মানসপটে নিজ নিজ মা ভেসে উঠে। আর সেই মা জীবিত থাকাকালে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কতই না খারাপ ব্যবহার করেছে... সেই সকল কথা মনে পড়াতে আজ অনেক দিন পরে এই লোকগুলি বিয়োগব্যথায় কাতর হয়ে পড়ে। কয়েকজনের চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে। খোদ হাবিব মুন্সী নিজ মায়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে উঠেন। তার কন্ঠ ধরে আসে। তিনি চীৎকার করে উঠতে চেয়েও পারেন না। তার বাজখাই আওয়াজ হঠাৎ করেই কেন জানি মিইয়ে যায়। না হলে আজ চান মিয়াকে অন্তত কথার বাণে তিনি বিদ্ধ না করে ছাড়তেন কিনা সন্দেহ।
সবার এই হট্টগোলের ভিতরে কে কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। এমন সময়ে এক নারী কন্ঠের আওয়াজে সকলে চুপ করে। পারুল পিছন থেকে একটু সামনে আসে। হাবিব মুন্সীর কপালে ভাজ পড়ে। পারুল চান মিয়াকে লক্ষ্য করে বলে, ‘ তোমাকে সবাই অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তু তুমি তোমার বউয়ের কথার উপরে তোমার মাকে বাড়ির বাহির করে দিয়েছ। এখন একটা কথা বেশ ভালোভাবেই জেনে যাও। ছেলে-মেয়েদের ইচ্ছামাফিক চলার দিন শেষ হয়েছে। বৃদ্ধ মা-বাবাকে বৃদ্ধকালে ভরণপোষণ না দিলে এর বিরুদ্ধে দেশে আইন হয়েছে। যাতে বেশ কয়েক বছর জেলে পর্যন্ত যেতে হবে। জরিমানার ও ব্যবস্থা আছে। এখন তুমি বল, নিজের মাকে দিয়ে ভিক্ষা করিয়ে জেলে যাবে, না মাকে সাথে নিয়ে নিজের বাড়িতে শান্তিতে থাকবে?’
চান মিয়া জেল-জরিমানার কথা শুনে একটু ঘাবড়ে যায়। তবে তা সামান্য মুহুর্তের জন্য। সে তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ কিরে মা, তুই আমার বিরুদ্ধে কেইস করবি?’ বৃদ্ধা আছিয়া বেগম অসহায় বোধ করেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে শেষে পারুলের দিকে চেয়ে থাকেন। এই মেয়েটির সাথে এই সালিশে আসার আগে তার অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। সে তাঁকে অনেক কিছু বুঝিয়েছে। তাই নিজের ছেলের এই প্রশ্নের জবাবে ছেলের দিকে না তাকিয়ে সে প্রথমে চুপ থাকে। ছেলে মাকে আবারও প্রশ্ন করলে আছিয়া বেগম নিজের মমতার গলা টিপে ধরে বলেন, ' হ, লাগলে তাই করমু।‘
ছেলে মায়ের কথায় নিরাশ হয়ে পড়ে। একটু রাগও হয়। ক্রমে সেই রাগটা চান মিয়ার সর্ব শরীরে ছড়িয়ে পড়ে ওকে একটা পশুতে পরিণত করতে চায়। সে পারুলের দিকে তাকিয়ে বেশ জোরের সাথে বলে উঠে, ‘ ঠিক আছে, তোর উস্কানিতে আমার মায় আমার বিরুদ্ধে কেস করবে। আচ্ছা করুক। দেখা যাউক কি করবার পারে। ‘
এ কথা বলে চান মিয়া তার বউকে নিয়ে সালিস থেকে বের হয়ে যায়। উঠানে নেমে এসে কি মনে করে আবার একা ফিরে আসে। ওকে আজ কথায় পেয়ে বসেছে যেন। কাছারি ঘরের দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে পারুল ও মুজিবরকে লক্ষ্য করে বলে, ‘ সালমার জামাই কেস তুইলা নিছে এইডা জানো তোমরা? বহুত তো আইছিলা বুদ্ধি দিবার... কেস করার পর হইলোডা কি? আহ? ঐ মুন্সী কলকাঠি নাইড়া সালমার জামাইরে টাকা খাওয়াইয়া কেস উঠাইয়া নিছে। আমার বেলায়ও দেখা যাইবো আনে।‘ এ কথা বলে চান মিয়া হাসতে হাসতে বউকে সাথে নিয়ে সালিশে আসা সকল মানুষের সামনে দিয়ে উদ্ধত ভাবে চলে যায়। হাবিব মুন্সীর ইচ্ছে হচ্ছিল তার লোকজনকে বলে, ব্যাটারে ধইরা ইচ্ছে মতো ডলা দিতে। কিন্তু সে মাথা ঠান্ডা রাখে। কারন যাবার সময় ইতরটা এমন একটা কথা সবার সামনে ফাঁস করে দিয়ে গেলো, যাতে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাই হাবিব মুন্সী একেবারে নির্জীব হয়ে পড়ে থাকে।
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত পারুলের ঘরে ওর মা-বাবা, মোতাহার এবং মুজিবর আলাপ করে। সালমার আত্মহত্যায় প্ররোচনামূলক মামলাটি শেষ পর্যন্ত ওর স্বামী তুলে নিলো! এই ব্যাপারটি পারুলকে ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছিলো। মোতাহারকে সে সরাসরি বলেও ফেলে, ' সালমার ব্যাপারটায় আমরা হাবিব মুন্সীর কাছে হেরে গেলাম, না?' মোতাহার নিজেও ব্যাপারটায় অনেক শকড। কারণ এই সালমার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পুরো গ্রাম এক হয়েছিল। একটা নব জাগরন তৈরী হয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে প্রাথমিক সফলতাও এসেছিল। কোব্বাত মিয়া এবং সাহাবুদ্দীন বিএসসিকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। কিছুদিন তারা হাজতের ভাত খেয়ে এসেছে। এরপর জামিনে বের হয়ে আসে। সাহাবুদ্দীনকে সাময়িক সাসপেন্ড করা হয় স্কুল থেকে। এসব দেখে মোতাহারও কি কখনো ভাবতে পেরেছিল যে খোদ সালমার স্বামী বাসেত আলীই মামলা তুলে নিবে। তবে বাসেত নিজেই এই মামলার বাদী। তাই মামলা উঠিয়ে নেবার এখতিয়ার সম্পুর্ণ তার হাতে।
মোতাহার পারুলকে বলে, ' এখানে হার-জিতের কোনো ব্যাপার নেই পারুল। আমরা এই কাজ কেন করছি? নিছক জিতবার জন্য? মোটেই না। আমরা সমাজ পরিবর্তনের জন্য পথে নেমেছি। আর এটা এতো সহজ নয়। তুমি এলে, দু'একটা কাজ করলে আর অমনি সমাজ পরিবর্তিত হয়ে গেলো? ' পারুল চুপ করে থাকে। তাই দেখে মোতাহার আবার বলে, ' আমরা হাবিব মুন্সীর বিরুদ্ধে নই পারুল। আমরা এমন একটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে যাকে নেতৃত্ব দিচ্ছে এই হাবিব মুন্সী। সম্পর্কে কিন্তু সে তোমার আমার দুজনেরই চাচা। তারপরও এখানে সম্পর্ক কোনো মানে রাখে না। ঠিক সেভাবে এক সালমার ব্যাপারটায় নেগেটিভ কিছু আসাতেও হতাশ হবার কিছু নেই।
মুজিবর এবার কথা বলে, ' আর আমরা নিজেরাই তো দেখেছি, সালমার মৃত্যুর পরে কীভাবে গ্রামের সকলে ফুঁসে উঠেছিল। কীভাবে সবাই এক হয়েছিল... তার মানে চাইলেই আমরা সবাই এক হতে পারি। এই যে একটা আত্মবিশ্বাস নিজের এবং অন্যদের মনের ভিতরে তৈরী হয়েছে, এটাকে তুমি এতো ছোট করে দেখো না পারুল।'
পারুল দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মোতাহার এবং মুজিবর বিব্রত হয়ে একে অন্যের দিকে তাকায়। কিন্তু পারুল শান্ত না হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকে। পারুলের মা ও বাবা তাঁদের রুমের দিকে চলে যান। কিছুক্ষণ পরে পারুল চোখ মুছে ওদেরকে বলে, 'স্যরি, নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। সালমা আমার খুব প্রিয় বান্ধবী ছিল। ওর জন্য কিছুই করতে পারলাম না।'
মোতাহার এবারে একটু গম্ভীর হয়। ওর চোয়াল দৃঢ় হয়। সে বলে, ' আমরা একেবারেই যে কিছু করতে পারি নাই, তোমাকে কে বলল? ছেলেমেয়েদের স্কুল সকল বাঁধাকে অতিক্রম করে করেছি। এখন সুন্দর ভাবে চলছে। সুদখোর চক্রের হাত থেকে গ্রামবাসীকে রক্ষা করেছি কৃষি ব্যাংকের শাখা আনার মাধ্যমে। প্রসূতি মায়েদের জন্য মহিলা ডাক্তারের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছি। খুব দ্রুত ডাক্তার এসেও যাবেন। এই ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রোগীকে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে যে কঠিন বিধি নিষেধ ছিল, সেটাও অনেকটা অতিক্রম করেছি। পানি পড়া, জিনে ধরা এসকল গ্রামীন কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালিয়েছি নিরীহ গ্রামবাসীদেরকে। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণের ব্যাপারেও তো আজ সকলকে তুমি নিজেই সচেতন করলে। এগুলো কি তোমার চোখে পড়ে না পারুল?'
পারুল এবারে হেসে পরিবেশটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। সে সব কিছু বুঝেও সালমার ব্যাপারটায় এভাবে হেরে যাওয়াটা আসলে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। কিন্তু এখানে ওদের কিছুই তো করণীয়ও নেই। তবে পারুল আছিয়া বেগমের ব্যাপারটা নিয়ে খুব চিন্তা-ভাবনা করে আগাবে সিদ্ধান্ত নেয়। মোতাহারকে বলেও সে কথা। এই ব্যাপারে ওরা দুজন পারুলকে নিশ্চয়তা দেয় যে, এবার আর কোনো ভুল হবে না। মোতাহার আছিয়া বেগমকে পারুলদের বাড়ীতে রাখার কথা বললে পারুল রাজী হয়। মোতাহার আরো জানায় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটা থোক বরাদ্দ সে আছিয়া বেগমের নামে দেবার ব্যবস্থা করে দিবে।
তিনজন ভিন্ন মায়ের সন্তান 'সম্প্রতি ছেলে হারানো' এক মুসাফির মায়ের জন্য যেভাবে চিন্তা-ভাবনা করে... তাঁকে নিজেদের মায়ের মতো আগলে রাখতে চায়... এটা দেখে খোদ মায়া-মমতার সৃষ্টিকারী সেই স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও খুব আনন্দ বোধ করেন। তার অপার করুনা বর্ষিত হতে থাকে শ্রীরামকাঠী নামক এক অখ্যাত গ্রামের তিনজন ছেলেমেয়ের উপর।
এভাবে সারা দেশের যুবকেরা যদি সমাজ পরিবর্তনে এগিয়ে আসতো... অন্তত নিজের দেশটাকে ঐ বৃদ্ধা মায়ের মতো ভেবে এক একজন পারুল-মোতাহার-মুজিবর এর মতো হৃদয়ের ভালোবাসাটুকু নিংড়ে দিতো... তবে এই দেশটার অবস্থা আজ এরকম হতো না।
... ...
মানুষের মনের ভিতরে যে সকল চাওয়া-পাওয়া প্রতিমুহুর্তে বিকশিত হয়, সেগুলোর কোনো একটিও যদি ঠিকভাবে পুর্ণতা লাভ না করে, তবে মনের শান্তি আসে না। পারুলের এখনকার অবস্থাও এমনই। যে আশা নিয়ে সে নিজ গ্রামে ফিরে এসেছিল, শুন্য থেকে শুরু করে নিজেদের গ্রামকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, বিরুদ্ধবাদীদের চক্রান্তে সেই লক্ষ্য একটা পিচ্ছিল বাঁশে চড়ার মতো বারবার পিছলে পেছনে নেমে আসছে। কিছুটা প্রাপ্তি যদিও ওকে আশান্বিত করছে, কিন্তু ব্যর্থতাগুলো হৃদয়ে শেলসম আঘাত করে চলেছে।
নিজের স্বামীর দ্বারা প্রতারিত হয়ে সে নাইয়র এসেছিল। ইচ্ছে করলে নতুনভাবে সংসার করতে পারতো। কিন্তু আজন্ম প্রতিবাদী পারুল তার ভিতরের কিছু সফিস্টিকেটেড ফিলিং এর দরুন ওর আশেপাশের চরম বৈরী পরিবেশকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারেনি। তাই মোতাহার এবং মুজিবরের মতো একই চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত দুজনকে পাশে নিয়ে নতুন কিছু একটা করার উল্লাসে মেতে উঠে। আসলে নতুন কিছু ছিল না সেগুলো। বরং পুরাতনকে ভেঙে সরিয়ে দিয়ে সঠিকটিকে রুপ দেয়ার কাজটিও কিন্তু একেবারে নতুন কিছু না। এগুলো যুগে যুগে একই... সত্যম-শিবম-সুন্দরম। যা-ই ভালো, তা-ই সত্য। এই সত্যকে সামনে নিয়ে পারুল আগাতে চাইছে।
পারুল নাইয়র এসেছে প্রায় এক বছর হয়ে এলো। এই সময়টিতে সে তার নিজের দৃষ্টিতে গ্রামবাসীদেরকে বেশকিছু সমস্যায় জর্জরিত দেখতে পেয়েছে। এর ভিতরে ছিল শিক্ষার অভাব, আর এর ফলে প্রাচীনপন্থীদের দ্বারা অবিরাম নিষ্পেষণের শিকার হচ্ছিল সাধারন এই মানুষগুলো। তবে সবচেয়ে অসহায় ছিল নারীরা। এই নারীরা ছিল চরমভাবে অবহেলিত। নিষ্পেষণের শিকার সাধারণ মানুষদের দ্বারা প্রতিমুহুর্তে এরা অধিকতর প্রেষণে দিশেহারা হয়ে এক গুমোট জীবনধারণ করছিল। এদের কেউ কেউ নিজ নিজ স্বামীর দ্বারা... কেউ সমাজপতিদের বিকৃত লালসার ভিতরে না দেখা এক বোবা কান্নায় নিরন্তর মরে মরে বেঁচে চলেছে। কেউ যৌতুকের বলি হয়েছে, কেউ কুমারি মা হবার পরবর্তী ধাপগুলোতে টিকতে না পেরে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। বাল্যবিবাহের সিস্টেমেটিক ফাঁদে পড়ে কেউ অসময়ে মা হতে গিয়ে অকাল মৃত্যুকে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে, নচেৎ ফি-বছর সন্তানধারণের কষ্টকর মুহুর্তগুলোতে একজন মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে করে সময়ের আগেই বুড়িয়ে গেছে।
পারুল এই মেয়েদেরকে নিয়ে কিছু একটা করার চিন্তায় দিনরাত বিভোর থেকেছে। কিন্তু সমাধান করার কার্যকর কোনো পথ পায়নি। একেবারেই যে পায়নি, তা নয়। তবে সেই পথে চলতে গিয়ে প্রতি পদে পদে বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে। এমন লোকদের দ্বারা সেই প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে, যাদের দায়িত্ব ছিল গ্রামীন সমাজের অবকাঠামো ঠিক করার। কারণ তারাই ছিল সমাজের ক্রীম-পার্সন। অথচ এরা মাঝখান থেকে সমাজের ক্রীমটুকু শুষে খেয়ে গোটা সিস্টেমটিকেই ছোবড়া বানিয়ে ফেলছে।
এইতো সেদিন দক্ষিণ কান্দার আলাওল মিয়ার স্কুল পড়ুয়া মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভীষণ ঝামেলার সৃষ্টি হল। বুড়িখালির সামছু মিয়ার ছেলের সাথে সম্বন্ধ ঠিক হয়েছিল। যথাসময়ে বরযাত্রী এলো। কবুল পড়ানোর আগেই গোল বাঁধল। দেনাপাওনা নিয়ে কথাবার্তা আগেই ঠিক হয়েছিল। কিন্তু শেষ সময়ে এসে ছেলেপক্ষের আরো কিছু অতিরিক্ত দাবীর মুখে অসহায় আলাওল মিয়া চোখে অন্ধকার দেখে। এক পর্যায়ে মঞ্চ থেকে বরকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যত হয় ছেলেপক্ষ। এক অসহায় পিতার কাকুতি মিনতি উপস্থিত সকলের মনকে নাড়া দিলেও সামছু মিয়াকে কোনো কিছুই টলাতে পারে না। বিয়ের অনুষ্ঠানে পারুল, মোতাহার দুজনেই উপস্থিত ছিল। পারুল সামছু মিয়াকে থামায়। বিয়ে না ভেঙে দিতে অনুরোধ করে। কিন্তু যৌতুকলোভী মানুষটি পারুলের কোনো কথাই শুনতে চায় না। শেষে পারুল বরকে জিজ্ঞেস করে, সে কি চায়? কিন্তু ছেলেটি তার বাবার সামনে কিছু না বলে মাথা নিচু করে থাকে। পারুল যা বোঝার তা বুঝে নেয়। শেষে আলাওল মিয়াকে বলে য্ এরকম ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে নিজের মেয়ের সর্বনাশ করার কোন মানে হয় না। যে ছেলে এখনই বিয়ের আগে সামান্য কিছু অর্থের জন্য অন্ধভাবে নিজের বাবার অনুসরণ করছে, ভবিষ্যতে এই লোভী লোকটির আরো চাহিদার সামনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে মেয়েটিকে টর্চার করতেও পিছপা হবে না।
পারুল মোতাহারকে সকল বরযাত্রীকে যেতে দিয়ে বর এবং তার বাবাকে আটকে রাখতে বলে। সেই অনুযায়ী কাজ করা হয়। একটা শোরগোল পড়ে যায়। কিন্তু এলাকার চেয়ারম্যান এর সামনে বাইরের গ্রামের লোকজনের করার কিছুই ছিল না। পারুল মোতাহারকে থানায় খবর দিতে বলে। সামছু মিয়াকে জানায় যে, এমনিতেই আমাদের দেশে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আইন রয়েছে। তার উপর যৌতুক নেয়া আরো অপরাধ। কঠিন শাস্তি পেতে হবে এই দুই ধারায় মামলা করা হলে। আর এই কাজটিই করতে যাচ্ছে পারুল। এবারে সামছু মিয়ার টনক নড়ে। আলাওল মিয়াও পারুল এবং মোতাহারকে নমনীয় হতে বলে। কিন্তু ওরা দুজন যা বলেছে সেটা থেকে ফিরে আসতে চায় না। পারুল ভাবে, এই ব্যাপারটিতে নমনীয় হওয়া মানে সামনের দিনগুলোতে আরো পিছিয়ে যাওয়া। গ্রামের অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বাল্যবিবাহ রোধ করার এমন একটা সুবর্ণ সুযোগ কিভাবে পারুল হাতছাড়া করে?
আলাওল মিয়া পিছু হটতে চাইলে পারুল তাকেও ভয় দেখায়। মেয়ের বয়স আঠারো হবার আগেই তাকে বিয়ে দিতে চাওয়ায় তাকেও আইনের আওতায় আনা যাবে বলাতেই সেও আমতা আমতা করে চুপ থাকে। হাবিব মুন্সি বিয়ের অনুষ্ঠানে ছিলো না। পুলিশ আসার কিছু আগে সেও খবর পেয়ে চলে আসে। সব শুনে উভয়পক্ষকে মিমাংসা করার প্রস্তাব দেয়। বিয়ের আসর থেকে কোনো মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়া ঐ মেয়ের জন্য অমঙ্গলজনক, এ জাতীয় কথাবার্তা বলে মেয়ের বাবা-মাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ইস্পাত দৃঢ় স্নায়ুর অধিকারিনী পারুলকে সেদিন কোনো কিছুই বিভ্রান্ত করতে পারছিল না। সে বউয়ের সাজে সজ্জিতা মেয়েটির পাশে থেকে ওকে আগলে রাখার চেষ্টা করে।
ঐ দিনের ঘটনাটি পারুলের মনে বেশ প্রভাব ফেলে। সে এলাকার মেয়েদেরকে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করার পথ খোঁজে। আর চিন্তা-ভাবনার এক পর্যায়ে পারুলের মনে যে কথাটি সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলে সেটি হল এলাকার মেয়েদেরকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করে তুলতে হবে। প্রতিটি ঘরে ঘরে মেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠলে... নিজ বাড়িতে বসে আয় করতে শুরু করলে, এদেরকে আর পরাশ্রয়ী হয়ে নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হবে না। বাবা-মায়ের কাছেও সে বোঝা মনে হবে না। দ্রুত বিয়ে দিয়ে নিজেদের দায় শোধরাবার মনোবৃত্তিও দূর হয়ে যাবে। আর একই সাথে গ্রামীন অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে। পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে মেয়েরা এখন শহরে আয় করছে... নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর সংগ্রাম করছে... সফলও হচ্ছে। সেদিক থেকে গ্রামের মেয়েরা অল্প বয়সে বিয়ে করে স্বামীর সংসার আগলাতে আগলাতে জীবনের সুবর্ণ সময়কে পার করছে।
এখন কিভাবে গ্রামীন নারীদেরকে অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত করা যায় সেটাই ভাবছে পারুল। মুজিবরের ক্লাব ঘরে মোতাহার আর মুজিবরের সাথেও এ বিষয়ে আলাপ করেছে। কিন্তু ওরা দুজনও তেমন কোনো পথনির্দেশ করতে পারলো না। চিন্তা-ভাবনার এক পর্যায়ে মুজিবরের টেবিলে রাখা সেদিনের খবরের কাগজে পারুলের চোখ পড়ে। একটা খবর পারুলের সকল চিন্তার অবসান ঘটায়। পেপার হাতে নিয়ে ওদের দুজনকে দেখায় পারুল। প্রথমটায় ওরাও দুজন ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা আসলে পারুল কি বলতে চাচ্ছে। তবে পরক্ষণে দুজনেরই মুখে হাসি ফোটে।
হাতের কাজে গ্রামের মেয়েরা খুবই সিদ্ধহস্ত। মনের খোরাক মিটানোর জন্য এরা ছেলেবেলা থেকেই কিছু না কিছু সুচ-কর্মের সাথে নিজেদেরকে জড়িয়ে রাখে। মনের মাধুরী মিশিয়ে কাপরের সাথে সুই-সুতার মিলন ঘটিয়ে এক একটি অনবদ্য আর্ট-ওয়ার্ক বসার ঘরের কিংবা শোবার ঘরের শোভা বাড়িয়ে চলেছে যুগের পর যুগ। আর এগুলোর আবেদন এখন দেশের গন্ডি পেরিয়ে দেশের বাইরেও রয়েছে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে এক বিশাল মার্কেট গড়ে উঠছে। পারুল এই হাতের কাজকে কেন্দ্র করেই ওদের গ্রামের মেয়েদের আর্থিক মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাইলো।
শ্রীরামকাঠী গ্রাম উন্নতির আরো একটি মাইলফলক অতিক্রম করতে যাচ্ছে হয়তো। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল চক্র এই প্রগতিকে কি চোখে দেখবে সেটাও ভাবার বিষয়। তবে সব কিছুকে যদি আগেই ভেবে ভেবে করতে হয়, তবে অনেক প্রগতির পথই আলোর মুখ দেখতো না। পারুল, মোতাহার এবং মুজিবরও নতুন এই প্রজেক্ট নিয়ে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। ওরা এটাও জানে যে, পথে ওদের জন্য কেউ ফুল বিছিয়ে বসে নেই। কাঁটার আঘাত আসবে জেনেই পথে নামতে হবে। ওরাও সেভাবেই নামবে। যুগে যুগে সিস্টেমের গলদ শোধরানোর জন্য যারাই পথে নেমেছে, সবাইকেই এই কাঁটার আঘাত সয়েই তবে সামনে আগাতে হয়েছে।
আঘাতই প্রতিঘাতকে তৈরী করবে।
প্রতিঘাতই বিপ্লব তথা উন্নতিকে নিয়ে আসবে।
পরিবর্তনের সূচকে এক একটি আঘাত এক একটি নব-বিপ্লবকে তরান্বিত করবে।
আর এদের পিছনে থাকতে হবে আশার আকাশ ছোঁয়া ঝলক।
যা এই তিনজনের অঢেল রয়েছে।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১০৩১ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
একটাও বইতো দূরের কথা, কোনো ম্যাগাজিনেও আমার কোনো লেখা বের হয়নি। আমি ব্লগার আতিক খান এর উৎসাহে এখানে আপাতত লিখে যাচ্ছি।
আপনাকে ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা অনেক অনেক।
হ্যা, কখনো ছাপানোর চেষ্টা করিনি। জব করি একটা গার্মেন্টস এ। কীভাবে দিনের শুরু আর শেষ হয়, টেরই পাই না। আর বন্ধটা কেটে যায় পরিবারের সদস্যদের সাথে। এভাবে চলেছে এক জীবন- রুটীনে বাঁধা ছন্দবদ্ধ জীবন।
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য অজস্র ভালোবাসা এবং শুভেচ্ছা রইলো আপনার প্রতি।
ইনশা আল্লাহ বইমেলাতে আগে তোমার বই দেখার আশা রাখছি।@ আতিক খান
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন